Charming stone art with heart symbol on pink background, symbolizing love and connection.

অপেক্ষা: ভালোবাসার পরম শুদ্ধতম প্রতীক

মেইন সড়কটি পার হয়ে রেললাইন, রেলপথের দু-পাশ ঘিরে গায়গায় বইঘর। লাইব্রেরি-ঘুঁজি অতিক্রম করেই দেখা মেলল তোরণদ্বারের উপরে বড়ো অক্ষরে লেখা নামটি—সরকারি বিএল কলেজ। সেই কলেজ--যেখানে হৃদয় অপেক্ষারত একটা ভালোবাসার অনুসন্ধানে।

অপেক্ষা আর ভালোবাসা--শব্দ দুটোর মধ্যে একটা কেমন যেন মেলবন্ধন আছে। তাইনা? অপেক্ষা হলো সময়ের এক প্রকার প্রতীক্ষা। এটি একধরনের ত্যাগ। অপেক্ষাতে স্বার্থ থাকে। ভালোবাসা হলো হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি, যা নিজস্ব স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যের মঙ্গল বা সুখে সান্ত্বনা খুঁজে পায়। ভালোবাসা স্বার্থহীন ত্যাগ।

ভালোবাসা প্রকৃত হলে অপেক্ষা তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ, প্রকৃত ভালোবাসায় সবসময় তাড়াহুড়া বা চাহিদা থাকে না; থাকে ধৈর্য, প্রত্যাশা, এবং প্রতিশ্রুতি। অপেক্ষা হলো সেই পরীক্ষার সময়, যা ভালোবাসার সত্যতা প্রমাণ করে। অপেক্ষা এবং ভালোবাসা একসঙ্গে মিলিত হয়ে জীবনকে গভীর অর্থ দেয় এবং অনুভূতিকে করে আরও উজ্জ্বল।

অপেক্ষা of two hands holding, symbolizing love and connection.

তখনও ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা শুরু হয়নি। গেইটের কাছে একজন দাড়িওয়ালা চাচা। দাড়িতে মেহেদী রঙ করেছিল কিন্তু এখন কমলা রঙ ধরেছে।  ভালো করে কিছুক্ষণ নিরীক্ষা করলেন তিনি।  তারপর সালাম দিলেন। এবং বড় গেইটের ছোট দরজা আগলে ধরলেন। সে প্রতি-সালাম জানিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। দুপাশে ফুলের বাগান। রঙ-বেরঙের ফুল ফুটে আলো-আলো করে ধরেছে। বিশেষ করে নজর কাড়ে পথের দু-ধার দিয়ে গাদাগাদা হলুদ গাঁদা ফুলের বাহার। 

বাগানের ধারে ঘেঁষে বসা একটা উদাসীন বালক। বয়স আন্দাজ করা কঠিন।  তবে সাবালক। একটি পা ছড়ানো, অন্য হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে দুহাতে জড়িয়ে বসে আছে। জিন্স-প্যান্ট ময়লা হয়ে গেছে ধুলোয়, পায়ে মোজাবিহীন কেডস–এটাও ধোঁয়া না অনেকদিন। গায়ে স্টাইফের জামা, দলা-পেকে আছে। একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। সম্ভবত অপরিচিত লোক দেখে। এইবার দেখা গেল। কোঁকড়ানো ঘনকালো লোমশ বুক তার।  বুক-খোলা জামার ফাঁকে একটি সোনার চেন চিকচিক করছে। একটা লকেট-ও দোদুল্যমান।

একবার তাকালো মনে হলো। তারপর আবার মাথা নিচু। গালভর্তি দাড়ি-গোঁফ। মাথার চুল উষ্কখুষ্ক। নাতিদীর্ঘ। মাঝেমধ্যে সেখানে চিরুনি এবং কাঁচি চালিত হয়। স্টাইলিশ আছে বা কখনো হয়ত ছিল, অভ্যাসটা না চাইতেও থেকে গেছে। কিন্তু দাড়ি-গোঁফের অবস্থা একেবারে বিদিখিস্তি। গোঁফগুলো ফেঁপে নাকের ছিদ্র এবং গাল ঢেকে ফেলেছে। উঠে দাঁড়াল। টিনটিনে শরীর। চুলের মধ্যে বাম হাতের অঙ্গুলিসমষ্টি ঢুকিয়ে চুলকাতে চুলকাতে  আসছে। ঢুলছে না শরীর। প্রেমিক-প্রেমিক স্টাইল।

”সমৃদ্ধি! সমৃদ্ধি-কে দেখেছেন? ঐ বিভাগে পড়ে।” পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দিকে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দেখালো। ফুল-হাতা শার্টের আস্তিন গোটানো ।। কিছু লেখা। অস্পষ্ট। পড়া গেল না। হয়ত ব্লেড জাতীয় কিছু দিয়ে হাত কেটে লিখেছে। বিড়বিড় করে বললো, “আমার সমৃদ্ধি।”  চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। উদাসীন শান্ত সুর, বলল, “সমৃদ্ধি আমাকে বসিয়ে রেখে গ্যাছে স্যার, এখনো কেন আসছে না!” একটু থামল, ” একটু বেখেয়ালি। কিন্তু ঠিক আসবে। বলেছিল, ও ডিপার্টমেন্টে যাবে আর আসবে, আমি যেন এখানেই অপেক্ষা করি।

আরো হয়ত কিছু বলত। কিন্তু সেই কমলা দাড়ি নিয়ে চাচা এসে হাজির। ”স্যার, ওর কথা শুনে সময় নষ্ট করবেন না। একটা উন্মাদ। সবাইকেই থামায়ে এই-ভাবে সময় নষ্ট করে মাইনষের।” চাচা বললেন। কিছু রহস্য আছে। মনে মনে ভাবলেন কিন্তু খোঁচাতে গেলেন না আর। কে জানে কী খোঁচাতে কে বের হয়!

আসেন স্যার। প্রন্সিপালের কোয়ার্টার ঐ দিকে। আপনাকে আগায় দি’ , চলেন।

আপনি জানেন নাকি আমাকে?

অল্প শুনেছি। 

চাচা পথ দেখিয়ে হাঁটছেন। সোজা পিচঢালা পথ। দু-পাশে গাছের সারি। বিভিন্ন জাতের গাছ। কলেজটা অনেক পুরনো মনে হয়। মাঝেমধ্যে দু-একটি বড়ো বড়ো আম গাছ রাস্তার উপরে ডালপালা ঝাঁপিয়ে ছাউনি তৈরি করেছে। মেইন গেইট থেকে কিছুটা পথ যেতেই ডান পাশে শান বাঁধানো দীঘী। ছোট মেয়ে জলে ঢেউ দিয়ে দিয়ে কলসিতে জল ভরছে।  লাল শাপলা ফুলগুলো পাতার উপর ভেসে আছে। আকাশ থেকে নেমে আসা কুয়াশামন্ডল পানির সাথে ছুইছুই খেলছে। বামপাশে মন্দির। রং-করা মাটির সরস্বতীর মুখ দেখা যাচ্ছে। চারদিক শুনশান। গাছের পাতাগুলা কুয়াশায় ভেজা। কোনো চঞ্চলতা নেই ক্যাম্পাসে। কিন্তু এই সকালে একটা খটকার সূত্রপাত ত হয়েই গেল। সমৃদ্ধি! আমার সমৃদ্ধি! একটা অজানা উদাসীন দৈবের মুখে নামটা শুনতেই তার খোঁচা লেগেছিল। এখনো শুনশান স্তব্ধতার মাঝেও খচখচ করে যাচ্ছে। ছোটবেলায় একবার মাঠে খেলতে গিয়ে বাবলার কাটা ফুটে ভেঙে থেকে গিয়েছিল খানিকটা। বাবলার কাটা বড্ড খতরনাক হয়। অনেক দিন গোড়ালে পেতে হাটতে পারেনি। গোড়ালি পাতলেই খচখচ করে উঠত। তেমনই কি এই এই খচখচটাও?

চাচা কতোদিন চাকরি করছেন এই কলেজে?

বেশি না। বছর দুইয়ের একটু বেশি। আগে রিকশা চালাইতাম। বোউ মইরে যাওয়ার পর আর চালাই না। তার পর থেইকে বিএল কলেজের দারোয়ানের কাজ করছি।

ওই ছেলেকে জানেন?

ওই পাগলটা? চিনি না তবে এটুকু জানি বেচারা প্রেমে ছ্যাকা খাইছে। ঐ যে একটা মেয়ে—কী নাম—সমৃদ্ধি–হ্যাঁ–বোধহয় মেয়েটা কিছুদিন ছেলেটার সাথে লুটুসপুটুস করছে তারপর ছেড়ে দিছে। এখন এরকমই হয়। খাও-দাও ছেড়ে দাও। ছেলেটা সত্যিকার ভালোবাসছিল, এখন তার মাসুল গুণছে। এখন কি আর সেই ভালোবাসা আছে। যেমন ছিল শিরিন-ফরহাদ, ছিল লাইলি-মজনু। আর ছিল—-”আর ছিল রোমিও-জুলিয়েট” মনে করিয়ে দিলেন চাচাকে। চাচার প্রেমের গল্পে বেশ ইন্টারেস্ট আছে বোঝা যাচ্ছে। 

কোয়ার্টারে পৌঁছে দিয়ে চাচা চলে গেলেন। তাকে অভ্যর্থনা করে বাসায় ঢোকালেন প্রিন্সিপাল সাহেব। প্রিন্সিপাল সাহেবের স্ত্রী এলেন, সে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।  “বাবা, তুমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসো, আমি এখুনি চা রেডি করছি।” প্রিন্সিপালের স্ত্রী বললেন।

তিনজন একসঙ্গে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, ” আসতে অসুবিধা হয়নি ত, জয়ন্ত?” স্ত্রী বললেন, “তুমি ত বাবা, খুলনাতে প্রথম এলে এই। আনইজি লাগছে না ত নতুন পরিবেশ আবহাওয়া?

না না! ভালোই। 

চেয়েছিলাম বিয়েটা এখানেই হোক। লোকেশনও ঠিক। কিন্তু অকস্মাত— প্রিন্সিপালের বোউ থেমে গেলেন।

প্রিন্সিপাল গলা খ্যাকরানি দিয়ে উঠলেন, তারপর বলো। তোমার রিসার্চ কতদূর।

জয়ন্ত বলল, একটু পজ রয়েছে। নতুন একটা প্রজেক্ট হাতে নিতে হয়েছে। এটা আগে আকমপ্লিশ করে ওটা শুরু করব।

ভালো ভালো! তুমি একটু রেস্ট  করে নাও না জয়ন্ত। বিকালে বের হব। তোমার রিসার্চটা  নিয়ে তখন শুনব।

বিকালে কোথাও তারা বের হলো না। প্রিন্সিপাল সাহেবের স্ত্রী এসে বেশ কয়েকবার ইন্সিস্ট করেছিলেন, কিন্তু যেতে ইচ্ছে করেনি জয়ন্তর। ছাদে হাঁটাহাঁটি করে বিকালটা কাটাল সে। একবার অবশ্য মনে হয়েছিল ওই ছেলেটার সাথে তার দেখা করা দরকার। সে হয়ত আরো কিছু বলতে চায় তাকে।

কখনো কিছু ঘটনা মনের ওপর সূক্ষ্ম আচড় রাখে যায়। ভয় তৈরি করে। মন আপনা-আপনিই গল্প বানাতে থাকে। রহস্যের মত। ছেলেটা কি কোনো রহস্য উন্মোচন করছে জয়ন্তর কাছে। প্রিন্সিপালের মেয়ের নামও ত সমৃদ্ধি। তাহলে ছেলেটা যে সমৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করছে সে এ নয় তপ্রিন্সিপালের স্ত্রী অকস্মাত বলে থামলেন কেন? প্রিন্সিপালের গলা খ্যাকরানির সুরটা একটু অন্যরকম ছিল নাকি? লোকেশন কেন চেইঞ্জ করতে হলো? মনে হচ্ছে যেন সুডকু মিলে যাচ্ছে। তাহলে চাচা যে বলল এখনকার মেয়েরা খায়-দায়-ছেড়ে দেয়। তার মানে—ছি!

জয়ন্ত আর ভাবতে চায় না। এসব একটা ফালতু সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু কি? জয়ন্ত জিজ্ঞেস করে। সে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে ইউনিভার্সের সেই অমীমাংসিত ঘটনায়। ছোটবেলায় বইয়ের পাতায় টু-ডিতে সূর্য আর অন্যান্য প্লানিটগুলাকে যেভাবে ইক্সপ্লিছিট করা হয়েছে আমরা কি আসলেই এমন কোনো ইউনিভার্সে বাস করি? জয়ন্ত এমন মনে করে না। তার ভাষ্য সূর্য থেকে প্রত্যেক প্লানিট শুধু একটি অক্ষ বরাবর সরে যায় না। প্লানিটগুলা বরং দুই অক্ষ বরাবর সরে যায়। অর্থাৎ এক্স এবং ওয়াই উভয় অক্ষ বরাবর। এভাবে সূর্য এবং অন্য সকল প্লানিট খাতায় আঁকলে ছবিটা হবে অনেকটা প্যারাবোলা আকৃতির। অনেকটা হাস-মুরগির ছা ঢেকে রাখতে গ্রামে যে টুল ব্যবহার করা হয় তার মত।

parabola,
প্যারাবোলা-জ্যামিতিক ফিগার
হাঁস-মুরগির ছা ঢাকার টুলস। গ্রামে এগুলোকে চাঙারি বলে।

ভোরে প্রিন্সিপালের ওয়াইফ ডেকে ঘুম থেকে উঠালেন। দীঘিতে নিয়ে এলেন। দীঘির জলে আজকেও হালকা কুয়াশার আবরণ পড়েছে। অপর পাড়ের  চারতলা-ভবনটি আবছা-আবছা বোঝা যাচ্ছে।  কুয়াশার মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে লাল সাদা শাপলা-ফুল । বাগান থেকে ডালিতে ফুল ভরে মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন তারা। জয়ন্ত গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখল। ছেলেটা এখন শুয়ে আছে।

খায়-দায় কি? জয়ন্ত নিজের অজান্তে বলে ফেলল। আস্ফুট হলেও তিনি শুনে ফেললেন।

জয়ন্ত সামলে নিল। স্পষ্ট করে বলল, অদ্ভুত তার চোখ দুটো।

“খুব মায়ায় ভরা।” প্রিন্সিপালের ওয়াইফ যেন আর না বলে বলে পারলেন না। ”ভালোবাসা কী-না পারে!” একটা দীর্ঘ হাফ ছাড়লেন।

এইভাবে রোজ, পথে পথে, খেয়ে-না-খেয়ে, মানুষের অবজ্ঞা সয়ে, দিশাহারা হয়ে অপেক্ষা করে যাচ্ছে শুধু ভালোবাসার-মানুষের কথা রাখতে? ভাবতেই শুদ্ধতম ভালোবাসার একটা প্রতিকৃতি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। তাই না? কিন্তু জয়ন্ত মাথা থেকে সরাতেই পারছে না। ছেলেটা কে আর সে কেন সমৃদ্ধির নাম নিল? কাকে জিজ্ঞেস করলে সে সঠিক উত্তরটা পাবে ভেবে পাচ্ছে না। একবার ভাবল সমৃদ্ধির মা—না একদম ঠিক বুদ্ধি নয়। তাহলে সরাসরি সমৃদ্ধিকেই জিজ্ঞেস করা যাক। কী বলব? সমৃদ্ধি ওই ছেলেটা কেন তোমাকে খুঁজে? না বেশি ডাইরেক্ট হয়ে যায়। জয়ন্ত ভাবল শান্ত গলায় বলবে, ছেলেটা সেদিন তোমার নাম ধরে ডাকছিল। প্রশ্নগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে না। মেয়েরা সেন্টিমেন্টাল হয়ে থাকে। আমি তাকে পাগলের সাথে সন্দেহ করছি ইত্যাদি বলে যদি একটা নানাখানা বাঁধিয়ে বসে তাহলে বিয়ে ত দূরে থাক আমাকে খুলনা ছাড়া হতে হবে তখনই। সো সব থেকে ভালো হবে, জয়ন্ত ভাবছে, কাল যখন সমৃদ্ধি আসবে তখন, আসল সমৃদ্ধিকে দেখে ছেলেটা কী রিয়াক্ট করে। মোরওভার সমৃদ্ধির রিয়্যাক্ট বেশি ইমপরট্যান্ট। জয়ন্ত পরিকল্পনা করল গেইট থেকে ছেলেটার সামনে পর্যন্ত সমৃদ্ধির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। সাইকোলজি বলে মানুষের চোখ কখনো সত্য লুকাতে পারে না। সুতরাং আজ রাতটাই কেবল অপেক্ষার। কাল একটা-না-একটা উত্তর মিলবেই। 

ওই ছেলেটার অপেক্ষার দিনও হতে পারে কাল শেষ হবে!

বেলা দশটার দিকে ওরা মেইন সড়কে এসে দাঁড়িয়েছি। গাড়ি-মানুষে গিজগিজ করছে। বিআরটিসির একটি লাল বাস এসে থামল। কয়েকজন নামার পর নামল সে। অপূর্ব! জয়ন্তর রুচি আছে মাশাল্লাহ!

মেয়েটি যেন এক টুকরো শান্তির প্রতিমা।হালকা মাখনের মতো মসৃণ একখণ্ড শাড়িতে মোড়ানো,  আঁচলটি কোমল হাওয়ায় কখনো তার কাঁধে, কখনো বা পিঠে উড়ে উড়ে খেলছে।

ঘন কালো চুল, মাঝখানে সিঁথি কাটা। চুলগুলি খোলা । চোখ দুটি গভীর, যেন নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তির এক সমুদ্র। ঠোঁটের কোণে রয়েছে মৃদু হাসি।

হাতে সোনালি চুড়ি। চলার ভঙ্গিমা মুগ্ধ করার মতো—নির্বিকার, ধীর, আর সুরেলা।  যেন পৃথিবীর সঙ্গে তার গভীর সংযোগ। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম।

শাড়ির সাদা রঙ অনেক দিন কাউকে না-দেখার দুঃখ ও ভালোবাসার মিশ্র রূপ ধারণ করে, হালকা চটি পায়ে এলো সে।  জয়ন্ত দেখছে। প্রিন্সিপাল আর তার ওয়াইফের চোখমুখ উচ্ছলিত হলো। তারা মেয়েকে জড়িয়ে আদর করলেন।

মেইন সড়ক থেকে রেললাইনে আসতেই অদূর থেকে একটি ট্রেনের পোঁ-পোঁ হুইসেল শোনা গেল। পথে লাল-সাদা ডোরা-আঁকা লোহার বেড় নামানো হয়েছে। ওরা সবাই ক্রমে দাঁড়িয়ে। এ-পারের ও-পারের বইঘরে ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা করছে সবাই। আশেপাশের দোকানদারেরা কেউ কেউ সমৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে আছে নেত্র মেলে। যেন পার্বতী এসেছে কৈলাস থেকে।

ট্রেন চলে গেল। একটা হৈ-হৈ রোল পড়ল। সবাই শশব্যস্ত। লাইনের খোয়াগুলার ওপর খুব সাবধানে পা ফেলছে সমৃদ্ধি। জয়ন্ত দেখছে। কিছুই বলেনি এখনো। সমৃদ্ধিও বলছে না। সমৃদ্ধি জয়ন্তর কাছাকাছি এলো। হাত ধরল ওরা। জয়ন্ত সমৃদ্ধির চোখে তাকিয়ে আছে। সমৃদ্ধি তাকিয়ে আছে পথে। গেইটের কাছে এলো তারা। সমৃদ্ধি মনে মনে হাসছে। লজ্জাও লাগছে জয়ন্তর এমন অপলক তাকিয়ে থাকায়। কিন্তু মেয়েদের এই লজ্জাতেই আনন্দ। কিন্তু সে ত আর জানে না জয়ন্তর মনে অন্য নেশা। সত্য উদ্ঘাটনের নেশা। আরেকটু অপেক্ষা। তারপরেই ধরা পড়বে রহস্যের টুয়িস্ট।

সেই চাচা গেইট খুলে ধরল। জয়ন্ত আর সমৃদ্ধি শেষে প্রবেশ করল। প্রথমেই চোখ পড়ল ছেলেটার দিকে। টিনটিনে ছেলেটা সেই একই ভঙ্গিতে চুলের মধ্যে বাম হাতের পাঁচ আঙ্গুল ঢুকিয়ে চুলকাতে চুলকাতে  আসছে। সমৃদ্ধি শক্ত করে ধরল  জয়ন্তর হাত। ওর চোখে ভয়। সমৃদ্ধি চিনতে পেরেছে রুদ্রকে? রুদ্র কি সমৃদ্ধিকে ডাকবে ওর নাম ধরে? যদি ডাকে কী জবাব দিবে সমৃদ্ধি রুদ্রকে? কী জবাব দিবে সমৃদ্ধি জয়ন্তকে?

”নীলিমা! নীলিমা-কে দেখেছেন? ঐ বিভাগে পড়ে।” পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দিকে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দেখালো। তারপর বিড়বিড় করে বললো, “আমার নীলিমা।”  চোখ দুটো ছলছল করে উঠল সমৃদ্ধির। উদাসীন সেই শান্ত সুর, “নীলিমা আমাকে বসিয়ে রেখে গ্যাছে ম্যাডাম, এখনো কেন আসছে না! ও একটু বেখেয়ালি। কিন্তু ঠিক আসবে। বলেছিল, ও ডিপার্টমেন্টে যাবে আর আসবে, আমি যেন এখানেই অপেক্ষা করি।”

সমৃদ্ধি জয়ন্তর দিকে চোখ তুলে তাকাল। জয়ন্ত এখনো নির্বিকার তাকিয়ে আছে। গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল, ”রুদ্রর অপেক্ষা কি কোনোদিন কাটবে বল ত?”

জয়ন্ত পুরোই ভ্যাবাচ্যাকা। একে ত ছেলেটা আজ বলল নীলিমা। সেদিন বলল সমৃদ্ধি। আবার সমৃদ্ধি বলছে রুদ্র। এ টুয়িস্টের শেষ কোথায়?

রুদ্রটা আবার কে?

রুদ্র ওই পাগল ছেলেটা। দেখলা না গেটের সামনে। উশকখুশক। ওরা যেতে যেতে বলছে।

তুমি চিনো?

হ্যাঁ। আমাদেরই ডিপার্ট্মেন্টে পড়ত। আমি ত ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। ভাগ্যিস আমকে চিনে ফেলেনি!

মানে ফিজিক্স?

হুম। ফিজিক্স।

আর ওই নীলিমা? নীলিমাকে কে?

সে অনেক বড় গল্প। পরে আরেকদিন বলব। এখন চল ত….

এরকম গল্প আরো পড়তে এখানে ক্লিক করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *