“মস্তিষ্ক-বিভ্রাট”

“মস্তিষ্ক-বিভ্রাট”
বাজারে এসেছি চাউল কিনতে। রহমত কাকু, আমার পরিচিত দোকানদার। বললাম, “কাকু, একমণ ইরি-২৩ চাউল মেপে দেন। আমি একটা গাড়ি ঠিক করে আসি।”
হিরামনকে বললাম, “তুমি কি যাবে ভাই একমণ চাউল নিয়ে আমার বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে।” ও ‘হ্যাঁ’ বলল।
সামনে ড্রাইভার, মানে হিরামন, তারপর চাউলের বস্তা আড়াআড়ি রাখা, তারপর আমি গাড়ির দুপাশে দুপা দিয়ে বস্তা ধরে বসে আছি। কিছুদূর এসে ওয়াপদা থেকে নামতে যাব, হিরামন বলল, “দাদা একটু বসো, এক কাপ চা খেয়ে আসি।” “আচ্ছা, যাও।” ও গাড়ি থেকে উঠে গেল।
আমি গাড়ি ঠেলে সামনে এগুচ্ছি, আবার পিছাচ্ছি। বাই সাইকেল চালাতে না-পারা বাচ্চা ছেলেরা বাই সাইকেল পেলে যেমনটা করে। আমিও তেমন করছি, বেশ মজা লাগছে। মাঝে মাঝে পিক-আপ মোড়া দিচ্ছি, কোনো ভুমভুম্ আওয়াজ হচ্ছে না, তবু কেমন জানি নিজে মোটর ড্রাইভ করার আনন্দ লাগছে।
সামনে সুদীপ্ত দা দাঁড়িয়ে। শহরে থাকে। কোন একটা ব্যাংকে জব পেয়েছে ২০১৯-এ। অনেক মাস পরপর বাড়িতে আসে।
বললাম, “দাদা কেমন আছো? কখন এসেছ?”
কোনো উত্তর না করে উনি ভাবোদ্দেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি গাড়ির স্ট্যান্ড নামিয়ে উনার কাছে এলাম। “দাদা, কেমন আছো?” এবার উচ্চস্বরে বললাম।
এইতো, তুমি কেমন আছো?
ভালো। দাদা, তোমায় আগে একবার ডেকেছি, তুমি শুনতে পাওনি?
কই না। আমি তোমায় কেবলই দেখলাম।
ও। তা কবে আসলে?
কয়েকদিন এসেছি।
আচ্ছা, দাদা, দাঁড়াও ত, দোকানদার কাকুকে বললাম, এক মণ চাউল দিতে, কিন্তু গাড়িতে ত দেখি, এক প্যাকেট চাউল!
দোকানিকে বললাম, “কাকু, আপনাকে এক মণের বস্তা দিতে বলেছি। কিন্তু আপনি বোধয় ভুল করে প্যাকেটের চাউল দিয়ে ফেলেছেন।”
দোকানি বলল, “না, বস্তাই দিছি। তুমি ভালো করে দ্যাখো।”
তাকিয়ে দেখলাম, আসলেই, বস্তাটা গাড়ি
থেকে কেউ পাশে নামিয়ে রেখেছে।
সুদীপ্ত দা বলল, “জানো, আমি একটা সমস্যায় ভুগছি? ভয়ানক সমস্যা। ডাক্তার দেখিয়েছি, ডাক্তার বলেছে, এ সমস্যা যাবার না।” সুদীপ্ত দার চোখেমুখে বিষণ্ণ-মলিনতার ছাপ। আমিও বেশ চিন্তামগ্ন ভঙ্গিতে বললাম, “কেমন সমস্যা? কী সমস্যা?”
মানসিক সমস্যা।
মানসিক সমস্যা! তুমি মজা করছ দা।
না, না, মজা করব কেন।
তাহলে ত তোমার সাইকোলজিস্ট দেখানো দরকার।
দেখিয়েছি। কিন্তু কোনো ডাক্তার কিছু ধরতে পারছে না।
আচ্ছা, দাদা, কবে থেকে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে বল ত। মানে, ঠিক কবে তোমার ভিতরের পরিবর্তনটা তুমি বুঝতে পারলে।
একটু লজ্জার কথা। তাও বলি। মনোযোগ দিয়ে শোনো। তুমি ত আবার লেখালেখি করো। দ্যাখো ত কোনো কিছু আন্দাজ করতে পার কিনা?
আচ্ছা, মনোযোগ দিয়ে শুনছি।
সেদিন আমি আর দীপা, মানে তোমার বৌদি, আমরা একসাথে বাথরুমে শাওয়ার নিচ্ছি। ও চুলগুলো খোঁপা থেকে খুলে দিয়েছে। ভেজা চুলগুলো ওর চোখ মুখ বেয়ে খোলা বুকের ওপর আছড়ে পড়েছে। এ দৃশ্য আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। হঠাৎ দীপা আমাকে ডেকে বলল, “তোমার স্নান কি শেষ হলো? ডাইনিং-এ সেই কখন থেকে বসে আছি ভাত গুছিয়ে।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, এইতো হয়ে গেছে। আসছি।”
আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর আর বৌদিকে স্নানঘরে দেখলে না।”
দেখলাম, কিন্তু তখন আমরা দুজনেই বিছানায়। ও আমার বুকের ওপর লেপ্টে আছে। বাম হাত দিয়ে আমার গুচ্ছচুল মুঠি করে ধরেছে। আর ওর ঠোঁটদ্বয় আমার নগ্ন দেহে শীতল শিহরণ দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি কেমন যেন ঘাম ঘাম বোধ করছিলাম। ঠিক তখনই মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা ঘুরতে আরম্ভ করল। তাতে একটাই ব্লেড। কিন্তু বেশ জোরে বাতাস দিচ্ছিল।
কিন্তু, দাদা, তোমরা ত এখনও বিয়েই করোনি।
“হ্যাঁ। ওই হয় না, দু-একবার বিয়ের আগে, গার্লফ্রেন্ড থাকলে যা হয় আরকি।” দাদা লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে একটা হাসি দিল। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করল।
কিন্তু তুমি এবার হয়ত বিশ্বাস করবে না। তারপর আমি দেখলাম আমি বিছানায় না। আমার স্যুট টাই কোট পরা। অফিস শেষ করে ব্যাংকের মোড় ঘুরে ডাকবাংলার ক্লে রোড দিয়ে হাঁটছি। ডানহাতে আমার অফিসের ব্যাগ ঝুলানো।
হঠাৎ রাস্তার ওপাশ থেকে গোড়ালি উঁচিয়ে উঁচিয়ে দীপা ডাকছে, “এ্যাই দীপ, এ্যাই!” তোমার বৌদি আমাকে দীপ বলে ডাকে।
রাস্তা পার হয়ে ওর কাছে গেলাম। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “চলো-না কফিশপে গিয়ে এক কাপ কফি খাই।” আমরা Spark of Candle এ ঢুকলাম।
কিন্তু দাদা, তোমরা কফিশপে ঢুকছিলে।
সেটাই ত কথা! ভিতরে গিয়ে দেখি সেখানে আমার অফিসের কলিগরা বসে আছে। তাঁদের সাথেই নাকি আজ আমার ডিনার করার কথা।
“কী হচ্ছে ভাই আমার সাথে আমি কিছুই বুঝছি না!” দাদার চোখে জল নেমে এসেছে।
দাদা, তুমি বললে spark of Candle-এ ঢুকেছো। এটা কী, কোথায়।
এটা রয়েলের মোড়ে নতুন করেছে। হোটেল। অনেক সুন্দর। খুব দামী দামী খাবার পাওয়া যায় সেখানে। আসলে দামী দামী খাবার না। খাবার গুলোর দাম বেশি।
দাদা, তুমি গত বছর ইন্ডিয়া গেছিলে না, ওখানে কোনো মন্ত্রতন্ত্র জানা সাধু সন্যাসীর সাথে দেখা হয়েছিল কি?
হয়েছিল, একজন সাধু বাবা। গেরুয়া পরা। মাথায় মহিলাদের মতো লম্বা কোঁকড়ানো লালচে-সাদা চুল। আমার হাত দেখে বলল, তুমি ব্যাংকে জব পাবা। কিন্তু তারপর তোমার অনেক বিপদ আছে।
তুমি সন্যাসীর কাছে বিপদ মুক্ত হওয়ার উপায় শুনলে না?
কিন্তু আমি তারপর আমাকে আমার অফিসে আবিষ্কার করলাম। আর সন্যাসীর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই ত আমি চাকরি পেয়েছি।
তোমার মাথা দাদা, সত্যি আউলায় গেছে।
আরে আউলায় নাই। আচ্ছা, আমি ত ইন্ডিয়াতে যাইইনি! কিন্তু সন্যাসীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, এটা স্পষ্ট মনে আসছে।
সুদীপ্ত দা মুখে হাত দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল, “কোথায় হয়েছিল, কোথায় হয়েছিল…” তারপর হঠাৎ থেমে বলল, “কিন্তু তুমি কী করে জানলে আমার সন্যাসীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না?
আরে, তোমার সাথে আমার দেখা হলো কখন!” আমার গা ঝাড়া দিয়ে বলল, “তোমার সাথে কখন দেখা হলো আমার? আমি ত বারান্দায় বিছানায় শুয়ে ছিলাম। মা আমার মাথায় জল ঢেলে দিচ্ছিল। কাল রাত থেকে আমার ভিষণ জ্বর ছিল।”
হিরামন ডেকে বলল, “দাদা, চলো, আমার চা খাওয়া শেষ।”
দাদার বিলাপ শুনে আমি কথা ঘুরানের জন্য বললাম, “সুদীপ্ত দা, তুমি দইয়ের টাটি নিতে এসেছিলে না?”
দাদা বলল, “হ্যাঁ।”
“তাহলে আমি যাই। তুমি পরে আসো।”
ওয়াপদা থেকে নেমে দু তিনটা কারেন্টের খাম্বা অতিক্রম করার পর দেখি, সুদীপ্ত দা বাজারের দিকে যাচ্ছে। গা খালি, লুঙ্গি পরা, গলায় একটা গামছা ঝুলানো। একদম রাখাল বেশ। জিজ্ঞেস করল, “কুথায় গেছিলে।”
বললাম, “দাদা চাউল আনতে গেছিলাম। তুমি কুথায় যাচ্ছ?”
দাদা বলল, “দেখি চরের থেকে গরু কটা খেদিয়ে আনি। সন্ধ্যে হয়ে আসছে।”
তারপর বলল, “তোমার পিছনে চাউল কই, এতো দেখছি দইয়ের টাটি। তুমি আবার মোটর গাড়ি কিনলে কবে?”
পিছন ফিরে যেতে যেতে বলল, “সাবধানে চালিও।”
সুদীপ্ত দার সাথে কথা শেষ করে আমি জানালার কাচটা উঠিয়ে নিলাম। ড্রাইভারকে বললাম, “মহসীন রোড ধরে Spark of Candle নামের হোটেলের সামনে দাঁড়াবে। ওখানে আমার কলিগরা অপেক্ষা করছে। আর হ্যাঁ, একটা বাংলা গান চালিয়ে দাও ত। মাথাটা ঝিনঝিন করছে।”
ড্রাইভার বলল, “স্যার সিট বেল্টটা লাগিয়ে নিন।” আমি সিট বেল্ট লাগিয়ে মাথাটা এলিয়ে দিলাম সিটে।
“এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো, তুমি বলো তো…”
আমার বৌ গানটা গাচ্ছে, আর স্কুটি চালাচ্ছে। কী অসাধারণ সুর ওর গলায়। আমি স্কুটির পিছনে একপাশে দু-পা ঝুলিয়ে মহিলাদের মতো করে বসে আছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *