A woman lovingly cuddles her dog.

কুকুর এবং কিছু নিষ্ঠুর মানুষ: একটি অমানবিক গল্প এবং ছোট্ট শিক্ষা

সাইকেলের পিছনে মাকে বসিয়ে পাহাড়ি রাস্তার মত উঁচু-নিচু খাদ্র-ভাদ্র রাস্তা দিয়ে চলছি। গোড়া থেকে রাস্তার মাথা ধীরে ধীরে পিরামিডের মত আকৃতি নিয়েছে। দু পাশে জলাধার। কোথায় মালুম নেই। কখনো কখনো কাটা গাছ, গাছের ডাল পড়ে আছে। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে চালাচ্ছি সাইকেল। পুরো রাইডারদের মত। একটা শ্মশান মাড়ালাম। উড়ে এসেছি। মা বুঝতে পারেনি। বুঝলে আবার কত কী ফরমায়েস করা বা শোনা লাগত কে জানে! তারপর খানিকটা রাস্তা হেঁটে আসতে হলো। পরে পিচের রাস্তা। আবার যাত্রা শুরু। একটা ব্রিজ পার হয়ে দেখি রাস্তা কাদায় জমজমাট। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। কিয়া পাতা! কখন বৃষ্টি হয়েছে না আদৌ হয়েছে নাকি। স্বপ্নে সবই সম্ভব। আমিও কম যাই নাকি। কোনো থামাথামি নাই।

চলছে…সাইকেল…স্বপনোপুরে। চলছে…সাইকেল…

এক মহিলা পায়খানা ঘর থেকে মাথা ঠেলে তুলে জিজ্ঞেস করল, চায়না-দি কোথায় যাচ্ছ? মা সম্ভবত মিথ্যে কোনো এন্সার দিল। কারণ আমরা বিশাল কোনো কাজ গোপন রাখার চেষ্টা করি। আ ফিউ মোমেন্টস লেইটার, এক জলভরা বিলের মধ্যে পড়লাম। সাইকেল শুদ্ধ পড়ার কথা কিন্তু সাইকেলের কথা আর মনে নেই। শুরু হইছে নতুন চ্যাপ্টার। এই ঘেরে কারা যেন জাল চারো ফেলছে। চেনা জানা কেউ। আরো ফিউ মোমেন্টস পরে দেখলাম…

একজন একটা কুকুরের গা থেকে দা দিয়ে লোম চেঁছে ফেলছে।

লোম ছাড়া একটা কুকুর এখন বারান্দায় মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি ঘরের মধ্যে থেকে দরজা আড়াল করে দেখছি। যেন আমি একটা ছোটো বাচ্চা। সরাসরি দেখতে ভয় লাগছে। কুকুরটা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল। পরক্ষণে ফোস্‌ ফোস্‌ করে কেঁদে উঠল। ‘’এই লোকটা আমার লোম ফেলে দিয়েছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।‘’ বাচ্চাদের মত করে কথাগুলো বলল কুকুরটা। কিন্তু একদম স্পষ্ট শব্দে শুনতে পেলাম আমি। কুকুরের কষ্ট দেখে আমি বললাম, ওকে মেরে কেন ফেলছ না! সেই লোকটা সঙ্গে সঙ্গে দা দিয়ে গলা কেটে বারান্দায়ই দড়ির সাথে ঝুলিয়ে দিল। মাথাটা উল্টো হয়ে গলার চামড়ার সাথে ঝুলে আছে। স্বপ্ন দেখছিলাম। এলোমেলো স্বপ্ন।

ঘুমাতে পারলাম না আর। বালিশের পাশে মোবাইলটার আলো জালিয়ে দেখলাম ছয়টা বায়ান্ন। বাইরে কী পরিমাণ কুয়াশা জানি না। তবে মনের অন্দরে বেশ ভারি এক কুয়াশার চাদর অনুভব করলাম। মনে পড়তে থাকে কিছু কুকুর এবং মানুষের কথা।​

না, ভুল বললাম বরং মনে পড়ছে কিছু কুকুর এবং কুত্তার কথা।

সে সময় (মানে প্রায় বছর বিশেক আগে) জাস্ট একটা হাফ-প্যান্ট পরেই রাস্তায় চলতে পারতাম। মাজায় থাকত তাগি। তাতে আটটা গিরে দেওয়া ছিল। পড়া গিরা। একটা কড়ে আর কয়েকটা মোম দিয়ে আটকানো তাবিজ। কেউ পিছন থেকে হঠাত প্যান্ট খুলে দিয়ে দৌঁড় দিলেও খুব বেশি আসে যাবে না। অপমান ব্যাপারটা বুঝি না তবে বেশ রাগ হবে এবং সাউওমারানি, বাল এসব অটোমেটিকলি মুখে চলে আসবে। এসব শিখে গেছি। শিখে ত আরো অনেক কিছুই গেছি কিন্তু লিমিট আমার বাল পর্যন্তই। 

বিকেলবেলা পড়লেই দু গ্রামের ছোটো ছেলে থেকে বুড়ো সবাই কাঠের পুলের রেলিঙয়ে হেলান দিয়ে বা কেউ কেউ রেলিঙয়ের ওপর বসে। হাওয়া খায়। আমার মাথা এখনো রেলিঙ সমান। উপরে উঠে বসতে আমার ভয় আছে। ব্রিজটা ধলাই এবং পুতলোখালি (অধুনা পুতলাখালী) গ্রামকে সংযুক্ত করেছে। নিচে দিয়ে প্রবাহিত পোদা। এটা গাঙ বা নদীর নাম। একটা ছোট ছেলে রেলিঙ ধরে প্রবাহিত পানির ঢেউ দেখছে। কিছুটা স্বচ্ছ পানি। নোনা স্বাদ। দুয়েকটা মাছের পিঠ ভেসে উঠছে কদাচিত। 

হঠাত কিছু-একটা ঝুপ করে পড়ল পানির মধ্যে। ভেসে উঠল একটা কুকুর। লোম ভিজে গার সাথে লেগে গেছে। ঘেউ ঘেউ করছে। কুলে ওঠার জন্য দুই হাত দিয়ে সাঁতার দিচ্ছে। কিন্তু এগুতে পারছে না। প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছে।

কুকুর-A furry dog struggles to climb a muddy slope near a calm lake in Brzegi, Poland.

কখনো মানুষেরও এমন হয়। স্বপ্নের মাঝে। পিছনে বিপদ। দৌঁড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পা এগুচ্ছে না। টেনশনে তখন গলা ঘেমে যায়। তারপর নাক তারপর কপাল, মুখ। তখন যে কেমনডা লাগে। পরিস্থিতিতে না পড়লে বোঝা যায়?

সব ঠিকঠাক। হাওয়া বইছে। গরমের দিন। ব্রিজের ওপর মানুষের সমাগম। দু-চারটা কুকুরও আছে। বেশিরভাগ সব মানুষের খালি গা আর লুঙ্গি পরা। পোলাপানও আছে কয়টা। একজন মিশমিশে কালো লোক বিশকুট খাচ্ছিল। ছ’ফুট মত লম্বা। মাথায় কাচাপাকা পাতলা চুল। সুঠাম দেহ। এমন সুঠাম আর পাঁচ ফুট দশের উপরের লোক কেবল ধলাই গ্রামের রায়-পদবীধারী বাবু-বাড়ির পুরুষগুলোই হয়ে থাকে। কিন্তু হায়! সবগুলাই কি আর বাবু হয় কিছু কিছু কালাচানও হয়! পুলের মাঝ বরাবর বসে ছিল। একটা বিশকুট তক্তার পরে রেখে দিল। দু-একবার আতু আয়-আয় করল। আতু গুটি গুটি পায়ে এসে বিশকুট কামড়িয়ে খেতে থাকল। কে জানত একটু পর তার ‘ছেড়ে দে বাবা কুলে উঠি, আর বিশকুটের লোভ করব না’ অবস্থা হবে। ছোট্ট ছেলেটা কি জানত? সে ত আছে তার মজায়। নতুন নতুন দুনিয়া দেখছে। সবে হাফ-প্যান্ট পরা ধরেছে। বাল সাউও বলতে শিখেছে। এখন বিকেলবেলা সবার সাথে সে-ও হাওয়া খাচ্ছে আর নিচে তাকিয়ে জলের বয়ে যাওয়া দেখছে।

কেউ তার প্যান্ট খুলে দিলে সাউও বাল বলতে পারলেও সে কিন্তু ওই লোকটাকে গিয়ে বলতে পারে না, ধমক দিয়ে, সাঊও তুমি কুকুরটাকে জলে ফেলে দিলে কেন? কত কষ্ট হচ্ছে বেচারার! তোমার কি বাল এই অনুভূতিটুকু নেই? এ কেন কালাচানের উপরে কথা বলে এমন দাপট ওই দুই গ্রামের আর কারো কি ছিল সেই সময়? শোনা যায় তার কোনো এক মেয়ের (তার আসলে ছেলে-ছেলে করে চার-পাঁচটা মেয়ে) বিয়েতে নাকি এই কাঠের পুলে সে লাঠি নিয়ে রাত পাহারা দিয়েছিল। কিউকি যাতে পুতলোখালির কোনো গরীব লোক তার মেয়ের বিয়ে খেতে যেতে না পারে। যাদের নিয়মিত ভালো-মন্দ না জোটে তারা বিনা নেমন্তন্নে খেতে যায়—এমন লোক সে যুগেও ছিল, এ যুগেও আছে। লাঠি নিয়ে পাহারা দেয়া লোক সে যুগে ছিল, এখনো আছে। তফাত সে-যুগের লোকটা ছিল কালাচান-স্বয়ং মেয়ের বাপ, এ-যুগে মেয়ের বাপ থাকে না।

টুপ করে কালাচান বিশকুট খাওয়ারত কুকুরটাকে ফেল দিল পোদার গাঙে। এটা ছিল একটা ইঞ্জয়মেন্ট। কালাচানের জন্য ত বটেই। অন্য সকল দর্শকদের জন্যও। আর কুকুরটা ছিল এন্টারটেইনআর। এখানে আসলে ডিওজি টা কে? কালাচান না কুকুরটা? কুকুরটার লম্বা মুখের মাথাটা হাবুডুবু খাচ্ছে। সাঁতরাতে পারছে না। গলায় বেঁধে আছে দড়ি। মাঝে মাঝে দড়ি ধরে উঁচু করছে। কুকুরটা ফাঁস খাচ্ছে। আর হো হো করছে কালাচান।

কুকুর মেরে আনন্দ পাওয়া লোক আরো একজন আছে। তিনিও রায়-পদবীধারী তবে বাবু নন। তিনি সমধিক নির্মল-পাগল বলে পরিচিত। সে-ও একই কায়দায় কুকুরের গলায় ঢঁ পরিয়ে ফেলে দিত পুলের ওপর থেকে। তারপর ঝুলিয়ে পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে মারত। নির্মল বেঁচে আছে। কালাচান আর নেই। কালাচান মরেচেও বেশ চুবনি খেয়ে খেয়ে। বেশ ভুগে-টুগে তারপর ভোগের বাড়ি গেছে। পরলোক আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আরআইপি কালাচান!

তবে নির্মল লোকটা সত্যিই নির্মল। কিছুটা নির্ভেজাল। লোকের পুঙা পেরেছে অন্তত এমন কখনো শুনিনি। সে নারকেল গাছে ওঠে একদম ইঁদুরের মতন। লোকটার মাথায় কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল, বেটে মত, শরীর তার খাঁজা-গুন্ডা টাইপ। বিভিন্ন এলাকার মানুষের নারকেল গাছ ঝোড়ার কাজ করে নির্মল জামাই। মামার বাড়ির দিক থেকে একটু সম্বন্ধ আছে। তার বোউকে মাসিমা ডাকি। তাই তাকে জামাই ডাকি। তাকে মাঝে মধ্যে এ বেড়ে সে বেড়ে মানে আবডাল জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সে ভালো গাজা হজম করতে পারে। একদিনের কথা মনে আছে। সে এক দারুণ শিক্ষকের ছাপ রেখে গিয়েছিল।

জীবনে প্রথম যখন টেস্টোস্টেরন ক্ষরণ শুরু হয় এবং গোপনাঙ্গের গোড়ায় চুল গজায় তখন পোলাপানদের মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষণীয়। তার মধ্যে একটা হলো ইয়ার্কি মারা শুরু করা, সম্পর্ক না বুঝে এবং সিনিয়র-জুনিয়র মেইনটেইন না করে। তেমনই একটা সময়ে সে নামধরে বলেছিল, ‘’তোমার ত ঘটে কালির জল আছে, নিশি!‘’ সবাই তাকে পাগল-পাগল বলে ত সেদিন তাকেও পাগল-পাগল বলে খেপাচ্ছিলাম। সে রেগে গিয়ে উক্তটি বপ্ত করেছিল। সেদিন বুঝেছিলাম এবং শিখেছিলাম ঢের বেশি। বাচ্চারা সবসময় অনুকরণপ্রিয়। তাই এহেন কথা না বলা উচিত যা তারা পরবর্তিতে ব্যবহার করলে মানহানি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। সেটা নিজের বাচ্চা ত নয় অন্যেরটার সামনেও  নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *