এক ছোট ছেলে তার বাবার কাছে কাঁঠা

এক ছোট ছেলে তার বাবার কাছে কাঁঠাল খাওয়ার আবদার জুড়েছে। বাবা শান্ত সুরে বলল, “ঠিক আছে বাবা, তোকে আজকে হাঁটের থেকে কাঁঠাল কিনে এনে খাওয়াব।” ছেলে অধীর আগ্রহ নিয়ে বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করল। বাবা হাঁটে গেল, কাঁঠাল আনল, ভাঙল। তারপর কোষ তুলে তুলে খাওয়াচ্ছে। ছেলে বলল, “বাবা এটা কী?”
“কোষ।”
আঁটি দেখিয়ে বলল, “বাবা এটা কী?”
“আঁটি।”
কাঁঠালের কন্টকযুক্ত ছাল দেখিয়ে বলল, “বাবা, এটা কী?” বাবা বলল, “কাঁঠালের ছাল।”
ভুতো বের হলে ছেলে জিজ্ঞেস করল, “বাবা এটা কী?”
“ভুতো।” বাবা মহা বিরক্ত হয়ে গেছে। বিস্ময়ত্যক্তসুরে ছেলে এবার বলল, “বাবা তাহলে কাঁঠাল কই?”
বাবা ত ছাবালের প্রশ্ন শুনে অবাক। একেবারে হতভম্ব অবস্থা! বাজার থেকে এতো বড়ো একটা কাঁঠাল কিনে এনেও, ছেলে ছাল কোষ আঁটি ভোতা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেল না!
ভালোবাসাও ঠিক এই কাঁঠালের গল্পের মতো, ভালোবাসা বলে স্পেসিফিক কিছু হয় না আসলে।
পারস্পরিক সম্মান, শ্রদ্ধা, সাপোর্ট, একটু গা গরম করলে কপালে হাত দিয়ে চকিত বলে ওঠা, “ওমা, গা ত দেখি পুড়ে যাচ্ছে!”
অপর পক্ষ মৃদু হেসে বলা, “ও কিছু নয়।”
“ও কিছু নয় মানে? জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে আর বলছ ও কিছু নয়। এই নাও, থার্মোমিটারটা বগলে রাখ।”
“আহা, অত ব্যস্ত হয়ো না, এমনি ঠিক হয়ে যাবে।”
“একদম চুপ, যেটা বলছি সেটা করো।”
–এগুলো মিলেই আসলে ভালোবাসা।
ভালোবাসা ত হাজার বার ‘ভালোবাসি’ ‘ভালোবাসি’ বলা নয়।
অফিস যাওয়ার আগে টাই বাঁধতে বাঁধতে বলা, “টিফিনবক্সে সব খাবার গুঁছিয়ে দিয়েছি। একদম বাইরের খাবার খাবে না কিন্তু।”
তখন গালটা টেনে বলা, “ওকে, আমার লক্ষ্মী বউটা।” (সঙ্গে একটা নরম চুমু।)
অফিসে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে ওঠা। হ্যালো বলতেই, “সাবধানে পৌঁছেছ ত?”
“হ্যাঁ, একদম অসুবিধা হয়নি গো। এ্যাই, একটা ক্লায়েন্ট এসেছে, ফোনটা রাখি, কেমন?”
আচ্ছা।
প্রত্যেকদিন একই কাজ একই কথা বলতে যেন কারোরই বিরক্তি আসে না, এটা বুঝিয়ে দেয়ার নামই ভালোবাসা।
মাঝেমধ্যে চিনির বয়ামের (বয়ামটা চিনির না হয়ে দুধের বোতলও হতে পারে!) দুয়ার খুলে রেখে দিতে হয় ভুল করে, পিঁপড়ে ঝাড়তে ঝাড়তে প্রিয়জনের বিরক্তমাখা রক্তিমমুখখানা দেখতে পাওয়ার লোভে।
“কার কপালে যে এসে জুটেছি! কৌটোর প্যাঁচটাও ঠিকঠাক লাগাতে জানে না। অন্যসব লাগালাগিতে ঠিক পারদর্শী (বিড়বিড় করে)। পিঁপড়ে ভরে কী নানাখানা অবস্থা! বলি, (কৌটোর) মুখ যদি লাগাতে না শেখ চিনি খাওয়ার আর দরকার নাই। বলে দিলুম। কবে শিখবে রে বাবা!”
এ ভুলে, এ লোভেও যে ভালোবাসা মিশানো।
তারপর চুপটি করে পাশে বসে স্নিগ্ধ কেশপাশ আঙুলে তুলে আবার ছেড়ে দিতে দিতে বলা, “আর হবে না লক্ষীটি, এবার থেকে মনে করে মুখ লাগিয়ে রাখব (কৌটোর)।”
“ভুল হবে না ত?” (আদুরে গদগদ গলায়।)
“একদম হবে না। এই দ্যাখো, কান ছুঁয়ে বলছি।”
“হয়েছে। এখন যাও।” (বাহুতে ঠেলা দিয়ে ঠোঁটচেপে একটা মুচকি হাসি।
কখনও কখনও স্বামীই পাতায় ভরে যাওয়া উঠোনটা ঝাঁট দিক। তারপর স্টোভ জ্বালিয়ে গরম গরম ধোঁয়া-ওঠা এক কাপ লাল-চা করে মশারী উঁচিয়ে বলুক, “মহারাণী, আপনার চা।”
বালিশ ছেড়ে হাতের পিঠে হাই তোলা মুখ ঢেকে বলুক, “মহারাজা একবার ছাদে চলো। আজ ভোরে একটা স্বপ্ন দেখেছি।”
রেলিঙের ওপর ঝুঁকে দুবাহুর কনুই স্থাপন করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুটি মানুষ। দুপাশে রাখা চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়ছে। এঁকেবেঁকে উড়ে উড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। সূর্যস্নান করতে করতে কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ নিরবতায় কেটে যায় দুজনের।
“কী স্বপ্ন বললে না যে?”
মাথা নিচু করে টবের গোলাপে হাত বুলাতে বুলাতে মহারাণী বলে, “একটা পঙ্খীরাজ ঘোড়া ছুঁটে আসছে, ওই যে নখরের টগবগ শব্দ হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছ তুমি?”
“কই না ত!”
“এই তুমি আমার মহারাজ!”
মহারাজা রেলিঙ থেকে উঠে কাঁধটা ঘুরিয়ে দুবাহু আবদ্ধ করে মহারাণীর চোখের দিকে চেয়ে বলে, “কী স্বপ্ন দেখেছ সত্যি করে বলো-না, মহারাণী?” (মহারাণীর মাথা তখনো সামান্য নোয়ানো।)
এবার মহারাণী স্বামীর বুকে মাথাটা শুইয়ে ধীরে ধীরে বলে, “জানো, স্বপ্নে দেখলাম, ঘোড়ায় চড়ে আমাদের রাজকুমার আসছে।”
“সত্যি!” খুশিতে চক্ষু ভিজে আসে মহারাজার।
মহারাজা আরও জোরে জাপটে ধরুক মহারাণীকে তাঁর বুকের গহীনে। তারপর আলতো একটা চুমোয় ভরিয়ে দিক মহারাণীর কপাল।
এই-তো ভালোবাসা!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *